ডিপফেক প্রযুক্তি

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার তৈরি ডিপফেক প্রযুক্তি ভিডিওর আদ্যোপান্ত

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উদ্বেগের নতুন কারণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ডিপফেক প্রযুক্তি(Deepfake Technology)। ব্রিটিশ গণমাধ্যম চ্যানেল ফোরের একটি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সারা বিশ্বে প্রায় ৪ হাজার তারকা এবং বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ ডিপফেক পর্নোগ্রাফির শিকার হচ্ছেন। সাধারণ মানুষেরাও এই প্রযুক্তির ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ডিপফেকগুলো বিশ্বাসযোগ্য করে তৈরি সম্পূর্ণ বানোয়াট এক ধরনের কনটেন্ট। ডিপফেক প্রযুক্তিতে এআই(AI) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যক্তির মুখ ও ভয়েসের কারসাজি করে নকল ভিডিও বা অডিও ক্লিপ তৈরি করা হয়।

ডিপফেক প্রযুক্তি অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। একাধিক ব্যক্তির ডিপফেক তৈরি করে তাদের জিম্মি করা হতে পারে। এই ধরনের ভুয়া ভিডিওগুলি মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে মানুষের খ্যাতি এবং গোপনীয়তার জন্য গুরুতর হুমকি সৃষ্টি করে। এখন ডিপফেক প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বাস্তব এবং যুক্তিহীন কনটেন্টের মধ্যে পার্থক্য করা Increasingly কঠিন হয়ে পড়ছে।

ডিপফেক কি? (what is Deepfake)

ডিপফেক প্রযুক্তি

ডিপফেক মূলত এআইয়ের একটি ধরন। “ডিপফেক” শব্দটি ‘ডিপ লার্নিং(Deep Learning)’ অর্থাৎ গভীর শিক্ষা এবং ‘ফেক’ অর্থাৎ নকল বা ভুয়া এর সমন্বয় থেকে এসেছে। অঙ্কিত ছবি ও ভিডিওর সংশ্লেষণে দক্ষ এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সফটওয়্যার এই ধরনের ভিডিও তৈরি করে।

অতএব, ডিপফেকের সংজ্ঞা বিবেচনা করলে, এটি হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে কোনো ব্যক্তির নকল ভিডিও বা চিত্র সৃষ্টি করা। এতে ওই ব্যক্তির মুখ ও কণ্ঠস্বরকে প্রতিস্থাপন করার জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করা হয়। এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কোনো একজন ব্যক্তি বা সাবজেক্টের মুখকে অন্য একটি ভিডিওর উপরে স্থাপন করতে পারে।

এখনকার উন্নত ডিপফেক(Deepfake) প্রযুক্তিগুলো একটি ব্যক্তির মুখের নড়াচড়া, ছবি অথবা ভিডিও ব্যবহার করে সেই ব্যক্তির সম্পূর্ণ নতুন মডেল তৈরি করতে পারে। 

এই প্রযুক্তি শুধুমাত্র একটি চিত্রের ভিত্তিতে মুখের মডেল তৈরিতে সক্ষম, তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যত বেশি ডেটা নিয়ে কাজ করবে, তা তত বেশি বাস্তবসম্মত ফলাফল প্রদান করবে।

ফলে, রাজনীতিবিদ এবং সেলিব্রিটিদের এই ডিপফেকের সহজ শিকার হতে হয়। এছাড়া, যেহেতু ডিপফেক সফ্টওয়্যার ওপেন সোর্স(Open Source Platform) প্ল্যাটফর্মে প্রবাহিত, তাই ইন্টারনেটে ব্যবহারকারীরা এটি ক্রমাগত পরিমার্জনা করছে এবং ইতিমধ্যে তৈরি করা পুরনো ডিপফেকের ভিত্তিতে নতুন ডিপফেক তৈরি করার কাজ করছে।

ডিপফেকের উৎপত্তি

ডিপফেক প্রযুক্তি বিভিন্ন উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে, যা ফটোশপ, বিনোদন এবং শখের ব্যবহার সহ বিভিন্ন কার্যক্রমে প্রয়োগ করা হয়। ফটোশপের মতোই সফটওয়্যারটি তৈরি করার পেছনে আসল নির্মাতাদের কোনো খারাপ উদ্দেশ্য না থাকা সত্ত্বেও এটি মানুষকে খারাপ উদ্দেশ্যে ব্যবহার থেকে বিরত রাখতে পারেনি।

ফেস-সোয়াপিং(Face Swapping) প্রযুক্তিটি মূলত চলচ্চিত্র শিল্পে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এই প্রযুক্তির একটি জনপ্রিয় উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে ২০১৬ সালের ফিল্ম ‘রোগ ওয়ান(Rogue One: A Star Wars Story): এ স্টার ওয়ার্স স্টোরি’। এই চলচ্চিত্রে নির্মাতারা গ্র্যান্ড মফ তারকিন(Grand of Tarkin) চরিত্রের পুনরায় উপস্থাপনার জন্য ফেস-সোয়াপিং এবং ভিডিও সংশ্লেষণের প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। এর পাশাপাশি, চলচ্চিত্রটিতে প্রিন্সেস লিয়ার নাবালকের সংস্করণও তৈরি করা হয়। উভয় ক্ষেত্রেই আসল অভিনেতাদের মুখের মডেলগুলি স্ট্যান্ড-ইন অভিনেতাদের উপর বাস্তবায়িত হয়েছিল।

ব্যবহারকারীরা ডিপফেক প্রযুক্তি সম্পর্কে সচেতন হতে শুরু করেন যখন একটি রেডডিট(Reddit) ব্যবহারকারী “ডিপফেকস” নামে একটি পোস্ট করে জানান যে তিনি একটি মেশিন লার্নিং(Machine Learning) (LLM) অ্যালগরিদম তৈরি করেছেন, যা সেলিব্রিটিদের মুখ নির্বিঘ্নেই পর্নোগ্রাফিক ভিডিওতে রূপান্তর করতে সক্ষম। সেই পোস্টে ডিপফেক প্রযুক্তির কিছু উদাহরণ প্রদর্শিত হয় এবং থ্রেডটি দ্রুত জনসাধারণের মাঝে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পরে পোস্টটি বন্ধ করে দেওয়া হয়, কিন্তু এর মধ্যে প্রযুক্তিটি ব্যাপকভাবে পরিচিত পায়। এরপর ব্যবহারকারীরা এটি ব্যবহার করে নকল ভিডিও তৈরিতে হাত লাগায়।

১৯৯০-এর দশকে, বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার ভিশন প্রযুক্তির উপর উল্লেখযোগ্য গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। এই প্রযুক্তি মানুষের এবং প্রাণীর চিত্র বিশ্লেষণ এবং এর আকার, রঙ ও টেক্সচার শ্রেণীবিভাগের সাথে সম্পর্কিত ছিল। এই সময়ের মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ও মেশিন লার্নিং (এমএল) এর ব্যবহার করে একটি ব্যক্তির মুখাবয়বের ভিডিও ফুটেজ পরিবর্তন করে এবং সেটিকে ভিন্ন একটি অডিওর সাথে সমন্বিত করার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল। ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত ভিডিও রিরাইট প্রোগ্রামটি এই প্রযুক্তির বাস্তবায়নের একটি উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়।

ডিপফেক প্রযুক্তি কে আবিষ্কার করেছে?

ডিপফেক প্রযুক্তির কোনও একক উদ্ভাবক নেই। ডিপফেকের ভিত্তি হিসেবে মেশিন লার্নিং প্রযুক্তির বিকাশ ১৯৯০-এর দশকে শুরু হয়। তবে এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলোর মধ্যে একটি হল জেনারেটিভ অ্যাডভারসারিয়াল নেটওয়ার্ক (GAN), যা ২০১৪ সালে পিএইচডি গ্র্যাজুয়েট ইয়ান গুডফেলো দ্বারা উদ্ভাবিত হয়। তিনি পরে অ্যাপল(Apple)-এ যোগ দেন। GAN-এর বিশাল গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও, ডিপফেক প্রযুক্তির বাস্তবায়নে বিভিন্ন পণ্ডিত এবং শিল্প বিশেষজ্ঞদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

ডিপফেক কিভাবে কাজ করে

মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদমের সাহায্যে ডিপফেক সফ্টওয়্যার নির্মাণে একাধিক কৌশল ব্যবহৃত হয়। এই অ্যালগরিদমগুলি ডেটা বা তথ্য ইনপুটের মাধ্যমে নতুন কন্টেন্ট তৈরি করছে। কোনো ব্যক্তির মুখের অংশ প্রতিস্থাপন করার জন্য অ্যালগরিদমকে প্রশিক্ষন দিতে হয় এরপর এটি নির্ধারিত সময়ে কাজ সম্পন্ন করে। এর মাধ্যমে ডিপফেক নির্মিত হয়। সাধারণত, এই প্রক্রিয়া অটোএনকোডার বা জেনারেটিভ অ্যাডভারসারিয়াল নেটওয়ার্ক (GAN) এর মাধ্যমে পরিচালিত হয়।

এছাড়া ডিপফেক কন্টেন্ট তৈরি করতে দুটি প্রতিযোগী AI অ্যালগরিদম ব্যবহার করে। একটি অ্যালগরিদমকে “জেনারেটর” বলা হয়। নকল কন্টেন্ট তৈরি করে। অপরটি হলো “ডিসক্রিমিনেটর”। তৈরি করা কন্টেন্টটি কতখানি আসল তা নির্ধারণ করতে ব্যবহৃত হয়। এই দুটির সমন্বয়কে জেনারেটিভ অ্যাডভারসারিয়াল নেটওয়ার্ক (GAN) হিসেবে অভিহিত করা হয়।

ডিপফেক প্রযুক্তি’র ব্যবহার

ডিপফেক প্রযুক্তি

ডিপফেক প্রযুক্তির বৃদ্ধি নকল পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। যার ফলে অনেক সেলিব্রিটি পর্নের শিকার হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ডেইজি রিডলি, জেনিফার লরেন্স, এমা ওয়াটসন এবং গ্যাল গ্যাডট। শুধু সেলিব্রিটিই নয়, অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে যেমন মিশেল ওবামা, ইভানকা ট্রাম্প ও কেট মিডলটনের মতো উল্লেখযোগ্য নারীদেরও এই শিকারের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। ২০০৯ সালে প্রকাশিত DeepNude নামে একটি ডেস্কটপ অ্যাপ্লিকেশন আবিষ্কৃত হয়েছিল। এটি ব্যক্তির পোশাক অপসারণ করতে সক্ষম ছিল। পরবর্তীতে, এটি ইন্টারনেট থেকে সরিয়ে নেয়া হয়।

ডিপফেকের দ্বারা আক্রান্ত দ্বিতীয় গ্রুপটি হল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। এক্ষেত্রে, সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা(Barack Obama) কর্তৃক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে(Donald Trump) অপমানিত করার ভিডিও উল্লিখিত হয়েছিল। অন্য একটি ভিডিওতে, ন্যান্সি পেলোসির বক্তৃতা এমনভাবে সম্পাদনা করা হয়েছিল যেন দর্শকরা ভুলভাবে ধারণা করেন যে তিনি মাতাল ছিলেন (শ্যালোফেক Shalofake)। অন্য একটি ভিডিওতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে সদস্যপদ নিয়ে বেলজিয়ামকে উপহাস করতে দেখা গেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার চ্যানেল এমবিএন(MBN) তার নিউজ অ্যাঙ্কর প্রতিস্থাপন করতে ডিপফেক ব্যবহার করেছে।

ব্ল্যাকমেইল

পেনসিলভানিয়ার রাফায়েলা স্পোন তার মেয়ের চ্যালেঞ্জার প্রতিদ্বন্দ্বীদের দুর্বল করার জন্য একটি চিয়ারলিডিং গ্রুপের সদস্যদের অশ্লীল, মদ্যপান এবং ধূমপানের ডিপফেক ভিডিও শেয়ার করেছিলেন। সৌভাগ্যবশত, ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যরা পুলিশকে জানায় ফলে তার পরিকল্পনা তার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।

রাজনৈতিক

২০১৯ সালে, এমআইটি-এর মিডিয়া শিল্পী ফ্রান্সেসকা প্যানেটা এবং হ্যালসি বারগান্ড প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের(Richard Nixon) একটি ডিপফেক ভিডিও তৈরি করেন। এই ভিডিওতে দেখা যায়। নিক্সন অ্যাপোলো-১১(Apollo-11) প্রোগ্রামের ব্যর্থতা ঘোষণা করছেন এবং দাবি করছেন যে ক্রুদের কেউ চাঁদ থেকে ফিরে আসেনি। এটি নিক্সনের আসল বক্তব্য ছিল, কিন্তু ভিডিওর সংশ্লিষ্ট অংশ পরে যুক্ত করা হয়েছে।

শিল্পে

রাশিয়ান গবেষকরা দা ভিঞ্চির আকা মোনালিসার সাথে এই কাজটি করেছেন। ফ্লোরিডার ডালি মিউজিয়ামে দর্শকদের আকৃষ্ট করার জন্য আর্কাইভাল ভিডিও ফুটেজ পুনরায় তৈরি করা হয়েছিল।

অভিনয়ে

“রগ ওয়ান: এ স্টার ওয়ার্স স্টোরিতে,” প্রিন্সেস লিয়া এবং গ্র্যান্ড মফ তারকিনের মুখাবয়ব পুনঃনির্মাণের জন্য ডিপফেক প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়েছে। 

সিনেমায়

ডিজনি রিসার্চ স্টুডিও তার নিজস্ব ডিপফেক ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট নিয়ে কাজ করছে। এটি কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির জন্য ব্যয় করা সময় এবং আর্থিক ব্যয়কে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করবে। উপরে উল্লিখিত স্টার ওয়ার্স মুভিতে এই একই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে।

সামাজিক মাধ্যমে

গত ২০১৬ সাল থেকে স্ন্যাপচ্যাটে ফেস-সোয়াপিং ক্যামেরা বৈশিষ্ট্যটি চালু হয়েছে। একইভাবে, TikTok ব্যবহারকারীদের ভিডিওগুলিতে মুখ অদলবদল করার সুযোগ প্রদান করে এমন একটি কৌশল গ্রহণ করেছিল। এছাড়াও আরও অনেক ক্ষেত্রে এর ব্যবহার হতে পারে-

শিক্ষামূলক ও প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়ায় ব্যবহার

 ডিপফেক প্রযুক্তি শিক্ষাগত উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতে পারে, যেখানে শিক্ষক বা প্রশিক্ষকরা ভার্চুয়াল পরিবেশে বিভিন্ন ভাষায় ভাষণ বা বক্তৃতা প্রদান করবেন। এটি শিক্ষার্থীদের জন্য একটি আধুনিক শিক্ষণ পদ্ধতি হিসেবে কাজ করবে। যেখানে ভিন্ন পরিস্থিতি ও পরিবেশে শেখার অভিজ্ঞতা প্রদান করবে।

ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের পুনঃপ্রকাশ

ডিপফেক প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রাচীন বা ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের জীবনের চিত্রায়ন করা যেতে পারে। এতে ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের মুখাবয়ব এবং কণ্ঠ পুনরুদ্ধার করে তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলি বা দর্শন তুলে ধরা সম্ভব হবে। এটি গবেষণা এবং ডকুমেন্টারি নির্মাণের ক্ষেত্রে কার্যকরী হতে পারে।

পণ্য ও ব্র্যান্ড প্রচারে ব্যবহার

বিজ্ঞাপন এবং বিপণন ক্ষেত্রেও ডিপফেক প্রযুক্তির ব্যবহার হতে পারে। এটি পণ্য বা ব্র্যান্ডের প্রচারনায় নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে, যেখানে বিভিন্ন সেলিব্রিটির মুখাবয়ব এবং কণ্ঠ ব্যবহার করে একটি পণ্যের বৈশিষ্ট্য উপস্থাপন করতে পারবে। এমনকি, ব্যবহারকারী প্রতিক্রিয়া বা মিশ্রণ তৈরি করেও গ্রাহকের আকর্ষণ করা যেতে পারে।

অটোমেটেড কাস্টমার সাপোর্ট সিস্টেম

ডিপফেক প্রযুক্তি কাস্টমার সাপোর্ট এবং ক্লায়েন্ট সার্ভিসের ক্ষেত্রে নতুন অভিজ্ঞতা তৈরি করতে পারে। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট তৈরি করা যেতে পারে, যা ব্যবহারকারীদের সাথে বাস্তবসম্মতভাবে যোগাযোগ ও প্রয়োজনীয় কাজে সাহায্য প্রদান করবে।

চিকিৎসা পরামর্শ এবং স্কিন রেনোভেশন

ডিপফেক প্রযুক্তির মাধ্যমে চিকিৎসকরা স্কিন রেনোভেশন বা ফেসিয়াল সার্জারির পূর্ববর্তী ফলাফল সম্পর্কে একটি বাস্তবসম্মত ছবি বা ভিডিও তৈরি করতে পারবে। ফলে এটি রোগীদেরকে চিকিৎসার পর কী ধরনের পরিবর্তন আসবে সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা প্রদান করবে।

ডিপফেক এর ঝুকি

ডিপফেক প্রযুক্তির ব্যবহার কিছু গুরুতর ঝুঁকি এবং নেতিবাচক পরিণতি সৃষ্টি করতে পারে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকি নিচে দেওয়া হলো-

ভুয়া তথ্য ছড়ানো (Fake News): ডিপফেক প্রযুক্তি সহজেই ভুয়া খবর এবং তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। রাজনৈতিক, সামাজিক বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে এটি বিকৃত ভিডিও তৈরি করতে পারে। এটি জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে এবং গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা: ডিপফেক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যক্তিগত ছবি বা ভিডিও পরিবর্তন করা সম্ভব। এটি মানুষের গোপনীয়তার লঙ্ঘন হতে পারে। ব্যক্তিগত ভিডিও বা ছবি ব্যবহার করে অন্যদের ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য এটি অপব্যবহার করা হতে পারে, যেমন হুমকি, ব্ল্যাকমেল বা সামাজিকভাবে ক্ষতিকর উদ্দেশ্যে।

অর্থনৈতিক প্রতারণা: ব্যবসা বা আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ডিপফেক প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতারণা করা হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একটি কোম্পানির সিইও বা কোনো বড় ব্যক্তির মতো মুখের ছবি বা কণ্ঠ ব্যবহার করে ভুয়া মেইল বা ভিডিও তৈরি করে অর্থনৈতিক প্রতারণা ঘটানো যেতে পারে।

স্বাস্থ্যসেবা ও বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভুল ব্যবহার: ডিপফেক প্রযুক্তির মাধ্যমে ভুল বা অবাস্তব স্বাস্থ্যসংক্রান্ত তথ্য বা বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রচার করা হতে পারে। এর ফলে মানুষ স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ভুল ধারণা তৈরি করতে পারে, যা তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে ক্ষতি করতে পারে।

ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং পরিচয় চুরি: ডিপফেক প্রযুক্তির মাধ্যমে একজন ব্যক্তির ছবি বা কণ্ঠ চুরি করে তাকে অন্য কোনো কার্যকলাপে ব্যবহৃত হতে পারে। এতে ব্যক্তির পরিচয় এবং তার ব্যক্তিগত সুরক্ষা বিপন্ন হতে পারে, এবং এটি তার আইনগত অধিকার এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতা লঙ্ঘন হতে পারে।

ভ্রান্ত শিক্ষা ও গবেষণা তথ্য: ডিপফেক ব্যবহার করে শিক্ষামূলক ভিডিও বা গবেষণামূলক উপস্থাপনা ভুলভাবে তৈরি হতে পারে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা বা গবেষকরা ভুল তথ্য গ্রহণ করতে পারে, যা তাদের বিদ্যাশিক্ষা বা গবেষণার ক্ষেত্রে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।

শিল্পী ও সেলিব্রিটিদের ক্ষতি: সেলিব্রিটি বা অন্যান্য পাবলিক ফিগারের মুখ বা কণ্ঠ ব্যবহার করে ফেক ভিডিও তৈরি করে তাদের ব্যক্তিগত জীবনের বিপদ সৃষ্টি করতে পারে। এমনকি, ডিপফেক ভিডিওর মাধ্যমে তাদের প্রতি ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হতে পারে, এটি তাদের খ্যাতি এবং ব্র্যান্ডের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

ডিপফেক থেকে বাঁচার উপায়

কী শেয়ার দিচ্ছেন: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি ও ভিডিও শেয়ার করার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। অতিরিক্ত পরিমাণে ছবি ও ভিডিও শেয়ার না করাই উত্তম। শেয়ার করার সময় পরিমাণকে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে রাখুন। পাশাপাশি, শেয়ার করার সময়ে প্রাইভেসি সেটিং ব্যবহার করতে ভুলবেন না। সর্বাধিক নিরাপত্তার জন্য সম্ভাব্য সর্বোত্তম প্রাইভেসি অপশন নির্বাচন করুন।

শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুনঃ সামাজিক মাধ্যমে নিরাপত্তা বজায় রাখতে একটি শক্তিশালী পাসওয়ার্ডের ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডিপফেক থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য প্রতিটি সামাজিক মাধ্যমের আইডির পাসওয়ার্ড শক্তিশালী হওয়া উচিত।

অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার ইনস্টল করুনঃ মোবাইলে ম্যালওয়ার আক্রমণের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই আপনার ডেটা ও অনলাইন অ্যাকাউন্টকে সুরক্ষিত রাখতে সচেষ্ট থাকুন। এই ক্ষেত্রে, একটি কার্যকর অ্যান্টিভাইরাস অ্যাপ ব্যবহার করা অত্যাবশ্যক। এর মাধ্যমে সম্ভাব্য সাইবার হুমকি থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।

মেটাডেটা ম্যানেজমেন্ট: কোনো ছবি ও তথ্য শেয়ারের সময় মেটাডেটা ম্যানেজমেন্ট খুব জরুরি। শেয়ার দেওয়া তথ্যগুলো আপডেট করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে শেয়ারের তারিখ, লোকেশন ও কপিরাইট ওনারশিপ।

কনটেন্ট সোর্স: সাইবার নিরাপত্তার পাশাপাশি কোন জায়গা থেকে কনটেন্ট নিচ্ছেন, সেটিও জরুরি। ছবি ও ভিডিও পেলেই তা সত্যি বলে ধরে নেবেন না, সেটি কোন সোর্সের, তাও দেখতে হবে। দ্বিধা থাকলে সার্চ দিয়ে আসল জিনিস বের করুন।

ডিপফেক সম্পর্কিত আইন

ডিপফেক প্রযুক্তি

ডিপফেক প্রযুক্তি গত কয়েক বছরে দ্রুতভাবে বিস্তার লাভ করলেও, এ সম্পর্কে প্রচলিত আইন সমূহ এখনও অনেক দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কিছু দেশে এই প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণহীন রয়েছে। যেসব দেশ এ বিষয়ে আইন প্রবর্তন করেছে, তার মধ্যে একটি হলো চীন। চীনা সাইবারস্পেস প্রশাসন ঘোষণা করেছে যে, ডিপফেকের মাধ্যমে তৈরি হওয়া মিথ্যা খবর বেআইনি। উক্ত আইন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সব রাজ্যে ডিপফেক সম্পর্কিত পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ করে। একটি নতুন আইনে ডিপফেক বিষয়বস্তু নিষিদ্ধ করা হয়েছে যা জনসেবাকারীদের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রভাবিত করতে পারে।

২০১৯ সাল থেকে ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যে ডিপফেক বিতরণ পুরোপুরি বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছে। তবে রাজনীতিবিদরা স্বীকার করেছেন যে, উল্লেখিত আইন (অর্থাৎ, AB-730) কার্যকর করা চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে। AB-730 আইন অনুসারে, নির্বাচনের ৬০ দিনের মধ্যে রাজনীতিবিদদের কৃত্রিমভাবে তৈরি ভিডিও, ছবি বা অডিও ফাইল প্রচার করা বেআইনি।

শ্যালোফেক কী (What are Shallowfakes?)

শ্যালোফেক(Shallowfakes)হল একটি বিশেষ ধরনের ভিডিও যা স্পীড ইফেক্টের মাধ্যমে তৈরি করা হয়। সাধারণত, ভিডিওর গতি কমিয়ে দিলে বিষয়টি যেন প্রতিবন্ধী হয়ে যায়, আর গতি বাড়ালে তা ব্যক্তিকে অতিরিক্ত আক্রমণাত্মক দেখায়। উদাহরণস্বরূপ, ন্যান্সি পেলোসির একটি ভিডিওতে তার চেহারাকে মাতাল হিসেবে উপস্থাপন করার জন্য ভিডিওর গতি কমানো হয়েছিল।

অপরদিকে, স্পিড-আপ শ্যালোফেকের একটি প্রথিত উদাহরণ হলো সারাহ স্যান্ডার্সের টুইটে শেয়ার করা সিএনএন রিপোর্টার জিম অ্যাকোস্তার ভিডিও, যেখানে তাকে একজন ইন্টার্নের সাথের কথোপকথনে বেশ নিষ্ঠুরভাবে দেখানো হয়েছিল। শ্যালোফেকের আরেকটি নাম ‘ডাম্বফেক’ নামেও পরিচিত। এমন ধরনের ভুয়া বিষয়বস্তু সমাজে বিপর্যয়কর পরিণতি ডেকে আনতে পারে, যেমন কীভাবে মিয়ানমারে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছিল।

ডিপফেক হল একটি অত্যাধুনিক এবং সম্ভাবনাময় প্রযুক্তি। এটি বর্তমানে মানুষের মধ্যে ক্রমশ পরিচিতি পাচ্ছে। তবে এরও রয়েছে কিছু সুবিধা এবং অসুবিধা। এটি আমাদের সমাজে কখনো নেতিবাচক এবং ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বিভিন্ন শিল্পে আমরা কীভাবে এর মাধ্যমে সর্বাধিক লাভবান হতে পারি, তা বুঝতে আমাদের কিছুটা সময় প্রয়োজন। ইতিহাসে অন্যান্য উদ্ভাবনের মতো সময়ের সাথে সাথে এটির নিয়ন্ত্রণের জন্য নানা উপায় তৈরি হবে। সম্প্রতি ডিপফেক ভিডিও শনাক্তকরণের প্রযুক্তি উন্নয়ন লাভ করেছে এবং এ ক্ষেত্রে নতুন নীতি ও ব্যবস্থা কার্যকর হচ্ছে।

আরও পড়ুন:-

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *