শবে বরাত (Shab-e-Barat)

পবিত্র শবে বরাতের (Shab-e-Barat) ফজিলত, করণীয় ও বর্জনীয়

শবে বরাত ইসলাম ধর্মেরবরকতময় রাতগুলোর মধ্যে একটি, যা শা’বান মাসের ১৫তম রাতে পালিত হয়। এই রাতকে “লাইলাতুল বরাআত” (মুক্তির রাত) বলা হয়, কারণ এই রাতে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের গুনাহ মাফ করেন এবং রহমত বর্ষণ করেন। বিস্তারিত জানতে আর্টিকেলটি পড়ুন।

শবে বরাত আসলে কি?

শবে বরাত (Shab-e-Barat) ইসলাম ধর্মের একটি বিশেষ রাত। মুসলমানদের জন্য এটি ক্ষমা, আল্লাহর রহমত, মাগফিরাত এবং বরকতের রাত হিসেবে পরিচিত। এটি আরবী শা’বান মাসের ১৫তম রাত, যা বিশেষভাবে তওবা, ইবাদত ও আত্মশুদ্ধির লাভের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামে এই রাতকে “লাইলাতুন নিসফি মিন শা’বান” বা “শা’বানের মধ্যরাত” বলা হয়।

শবে বরাতের অর্থ কি?

শবে বরাত শব্দটি ফারসি ভাষা থেকে এসেছে, যেখানে “শব” মানে রাত এবং “বরাত” মানে ভাগ্য, যা “মুক্তির রাত” হিসেবে পরিচিত। ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী, এই রাতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের গুনাহ মাফ করেন, রিজিক নির্ধারণ করেন এবং পরবর্তী বছরের ভাগ্য লিখে দেন।

শবে বরাতের তাৎপর্য ও গুরুত্ব

শবে বরাত (Shab-e-Barat)

শবে বরাত ইসলামিক ক্যালেন্ডারের ১৫ শাবান রাতে পালিত একটি বিশেষ রাত, যা মুসলিমদের জন্য ক্ষমা ও বরকতের রাত হিসেবে বিবেচিত। এই রাতে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করেন এবং যারা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন, তাদেরকে মাফ করে দেন। এটি মুসলিমদের জন্য একটি আত্মবিশ্লেষণ, তাওবা ও দোয়া করার সুযোগ প্রদান করে, যাতে তারা আরও নেক আমল করার উদ্দেশ্যে নিজেকে প্রস্তুত করতে পারেন। শবে বরাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিম্নে আলোচনা করা হলোঃ

১. এটি গুনাহ মাফের রাত

🔹 রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:

“আরবী শা’বানের মাসের পনেরোতম রাতে আল্লাহ তাআলা নিকটতম আসমানে আসেন এবং বলেন ‘কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব কোনো রিজিক প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি তাকে রিজিক দেব।’ এই আহ্বান সুবহে সাদিক পর্যন্ত চলতে থাকে।”
(ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১৩৮৮)

🔹 এই রাতের মূল তাৎপর্য হলো আল্লাহ বান্দাদের গুনাহ ক্ষমা করেন এবং তাঁর দরবারে দোয়া কবুল করেন।

২. ভাগ্য নির্ধারণের রাত (কদরের রাতের সঙ্গে পার্থক্য)

🔹 কিছু ইসলামী বিশেষজ্ঞগণ  মনে করেন যে, এই রাতে বান্দাদের পরবর্তী এক বছরের ভাগ্য নির্ধারণ করা হয় কে জীবন পাবে, কে মৃত্যুবরণ করবে, কার রিজিক কেমন হবে ইত্যাদি।

🔹 সুরা আদ-দুখান (৪৪:৩-৪)-এ বলা হয়েছে:

إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُّبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ

অর্থ:
“নিশ্চয়ই আমি এক বরকতময় রাতে (আল-কুরআন) অবতীর্ণ করেছি। নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এই রাতে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়।”

🔹 তবে অনেক ইসলামী বিশেষজ্ঞগণ  ব্যাখ্যা করেন যে, এই আয়াত শবে কদরের (রমজানের রাত) সম্পর্কে বলা হয়েছে, শবে বরাত নয়।

৩. শবে বরাত তওবা ও আত্মশুদ্ধির রাত

🔹 রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন:

“এই রাতে আল্লাহ সমগ্র সৃষ্টি জগতে রহমত ও ক্ষমার দৃষ্টি দেন এবং শিরককারী ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন।”
(সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস: ৫৬৬৫)

🔹 শবে বরাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য হলো এটি আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার রাত।

৪. এটি নবী ﷺ-এর আমলের সঙ্গে সম্পর্কিত

🔹 হযরত আয়িশা (রা.) বলেন:

“এক রাতে আমি রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে বিছানায় না পেয়ে জান্নাতুল বাকী কবরস্থানে গেলাম। তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ সময় ইবাদত করছিলেন এবং উম্মতের জন্য দোয়া করছিলেন।”
(মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ২৬০৪২)

🔹 এই হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, রাসুলুল্লাহ ﷺ শবে বরাতে বিশেষভাবে ইবাদত ও দোয়া করতেন।

৫. শবে বরাত পরবর্তী দিনের রোজার ফজিলত

🔹 রাসুলুল্লাহ ﷺ শা’বান মাসে অধিক পরিমাণে রোজা রাখতেন এবং ১৫ শা’বানেও রোজার কথা উল্লেখ করেছেন:

“আমি শা’বান মাসে যত বেশি রোজা রাখি, অন্য কোনো মাসে তত বেশি রাখি না।”
(সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১১৫৬)

🔹 এই রাতের পরদিন রোজা রাখা মুস্তাহাব (সুন্নত)।

শবে বরাত সম্পর্কে কোরআন কি বলে?

কিছু ইসলামী বিশেষজ্ঞগণ  মনে করেন, শবে বরাত সম্পর্কে কুরআনে সরাসরি উল্লেখ নেই। তবে কিছু তাফসীরবিদ সুরা আদ-দুখান (৪৪:৩-৪) আয়াতের মাধ্যমে এই রাতের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেন:

إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُّبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ

অর্থ:

“নিশ্চয়ই আমি এক বরকতময় রাতে (আল-কুরআন) অবতীর্ণ করেছি। নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এই রাতে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়।”

অনেক ইসলামী বিশেষজ্ঞগণ ব্যাখ্যা করেছেন যে, এখানে উল্লিখিত “বরকতময় রাত” লাইলাতুল কদর (শবে কদর) হতে পারে, যেহেতু রমজানের রাতে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছিল। 

কোরআনের আলোকে পবিত্র শবে বরাত ও তার মর্যাদা

কোরআনে সরাসরি শবে বরাত শব্দটির উল্লেখ নেই। কিন্তু কিছু আয়াতের মাধ্যমে ইসলাম ধর্মের বিশেষজ্ঞগণ এই রাতের গুরুত্ব আলোচনা করেছেন।

১. শবে বরাত সম্পর্কে কোরআনের ব্যাখ্যাঃ

সুরা আদ-দুখান (৪৪:৩-৪)

অনেকে মনে করেন যে, নিম্নলিখিত আয়াতগুলো শবে বরাতের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে:

 إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُّبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ

অর্থ: নিশ্চয়ই আমি এক বরকতময় রাতে (আল-কুরআন) অবতীর্ণ করেছি। নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এই রাতে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়। (সুরা আদ-দুখান: ৩-৪)

🔹 অনেক ইসলামী চিন্তাবীদগণ  বলেন, এখানে উল্লিখিত “বরকতময় রাত” হল লাইলাতুল কদর (শবে কদর), যা রমজানের শেষ দশকে হয়।

🔹 কিন্তু কিছু ইসলামী বিশেষজ্ঞগণ  মনে করেন যে, এটি শবে বরাতের ইঙ্গিতও হতে পারে, কারণ হাদিস অনুসারে, এই রাতে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের ভাগ্য নির্ধারণ করেন।

২. কোরআনের অন্যান্য আয়াতঃ

যদিও কোরআনে সরাসরি শবে বরাতের নাম নেই, তবে আল্লাহর ক্ষমা ও রহমতের বিষয়ে অনেক আয়াত আছে, যা এই রাতের গুরুত্ব বোঝায়:

আল্লাহর ক্ষমা ও রহমত

 قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَىٰ أَنفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا مِن رَّحْمَةِ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ

অর্থ: বলুন, হে আমার বান্দারা! যারা নিজেদের ওপর অত্যাচার করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করেন। তিনিই পরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সুরা আজ-জুমার: ৫৩)

শবে বরাত সম্পর্কে হাদিস কি বলে?

শবে বরাতের রাতে বিশেষ কিছু আমলের উপর আলোচনা করা হয়েছে। ফলে, এই রাতের গুরুত্ব ইসলাম ধর্মেরশিক্ষায় বেশ কিছু হাদিসের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে। শবে বরাতের রাতের গুরুত্ব নিয়ে কিছু গ্রহণযোগ্য হাদিস রয়েছে, যা বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে।

(ক) রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:

শা’বানের মধ্যরাতে আল্লাহ তাআলা পৃথিবীর সবচেয়ে নিকটবর্তী আসমানে আসেন এবং বলেন কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। কোনো রিজিক প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি তাকে রিজিক দেব। কোনো বিপদগ্রস্ত আছে কি? আমি তাকে উদ্ধার করব। এই আহ্বান সুবহে সাদিক পর্যন্ত চলতে থাকে। (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১৩৮৮)

🔹 এই হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, শবে বরাত আসলে বিশেষভাবে ক্ষমার রাত।

(খ) রাসুলুল্লাহ ﷺ শবে বরাতে দোয়া ও কবর জিয়ারত করতেন

আমি রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে (শবে বরাতের রাতে) জান্নাতুল বাকী কবরস্থানে পেয়েছি। তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ সময় ইবাদত করছিলেন এবং উম্মতের জন্য দোয়া করছিলেন। (মুসনাদে আহমদ: ২৬০৪২)

🔹 এ থেকে বোঝা যায় যে, শবে বরাতে কবর জিয়ারত করা এবং দোয়া করা একটি ভালো আমল।

শবে বরাতের ইবাদত ও করণীয় আমল (প্রমাণসহ)

শবে বরাত ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাত, যা আল্লাহর রহমত, মাগফিরাত (ক্ষমা) এবং বরকতের রাত হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে এই রাতের আমল সম্পর্কে কিছু হাদিস বিশুদ্ধ (সহিহ) এবং কিছু হাদিস দুর্বল (দাঈফ) বা জাল (বানোয়াট) রয়েছে। তাই, শবে বরাতে যা করা উচিত এবং যা করা অনুচিত, তা কুরআন ও সহিহ হাদিসের ভিত্তিতে জানা জরুরি।

✅ শবে বরাতে করণীয় আমল (বিশুদ্ধ সূত্রসহ)

১. নফল নামাজ পড়া

🔹 রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:

“যে ব্যক্তি গভীর রজনীতে দুই রাকাত নামাজ পড়বে, আল্লাহ তাআলা তার গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১১৩০)

🔹 শবে বরাতে নির্দিষ্ট কোনো নামাজের সংখ্যা নেই, তবে রাসুলুল্লাহ ﷺ রাতের নামাজকে গুরুত্বপূর্ণ বলেছেন। তাই, এ রাতে তাহাজ্জুদ বা অতিরিক্ত নফল নামাজ পড়া যেতে পারে।

২. কুরআন তিলাওয়াত করা

🔹 কুরআনে এসেছে:

“যারা রাতে নফল নামাজ আদায় করে এবং কুরআন তিলাওয়াত করে, তাদের জন্য রয়েছে মহান প্রতিদান।”
(সুরা আয-জারিয়াত: ১৭-১৮)

🔹 শবে বরাতে কুরআন তিলাওয়াত করা একটি উত্তম আমল।

৩. তওবা ও ইস্তিগফার (ক্ষমা প্রার্থনা)

🔹 রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:

“শা’বানের ১৫তম রাতে আল্লাহ বান্দাদের প্রতি রহমত নাজিল করেন এবং বলেন  ‘কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। কোনো রিজিক প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি তাকে রিজিক দেব।’
এই আহ্বান সুবহে সাদিক পর্যন্ত চলতে থাকে।”
(ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১৩৮৮)

🔹 এ রাতে বেশি বেশি ইস্তিগফার ও তাওবা করা উচিত।

৪. দরুদ শরিফ পাঠ করা

🔹 কুরআনে এসেছে:

“নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতারা নবীর ওপর দরুদ পাঠ করেন। হে ঈমানদারগণ, তোমরাও নবীর ওপর দরুদ ও সালাম পাঠ করো।”
(সুরা আহযাব: ৫৬)

🔹 শবে বরাতে রাসুল ﷺ-এর প্রতি বেশি বেশি দরুদ পড়া একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল।

৫. আল্লাহর কাছে বিশেষ দোয়া করা

🔹 রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:

“শবে বরাতে আল্লাহ বান্দাদের ক্ষমা করেন, তবে যারা শিরককারী বা বিদ্বেষ পোষণকারী, তাদের ক্ষমা করা হয় না।”
(সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস: ৫৬৬৫)

🔹 শবে বরাতে নিজের ও পরিবারের জন্য দোয়া করা উত্তম।

৬. রোজা রাখা (১৫ শা’বান)

🔹 রাসুলুল্লাহ ﷺ শা’বান মাসে বেশি রোজা রাখতেন:

“আমি শা’বান মাসে যত বেশি রোজা রাখি, অন্য কোনো মাসে তত বেশি রাখি না।”
(সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১১৫৬)

🔹 শবে বরাতের পরদিন (১৫ শা’বান) রোজা রাখা মুস্তাহাব (সুন্নত)।

৭. কবর জিয়ারত করা

শবে বরাত (Shab-e-Barat)

🔹 হযরত আয়িশা (রা.) বলেন:

“এক রাতে আমি রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে বিছানায় না পেয়ে জান্নাতুল বাকী কবরস্থানে পেলাম। তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ সময় ইবাদত করছিলেন এবং উম্মতের জন্য দোয়া করছিলেন।”
(মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ২৬০৪২)

🔹 শবে বরাতে কবর জিয়ারত করা বৈধ, তবে বিশেষ কোনো নিয়ম নেই।

❌ শবে বরাতে অনুচিত কাজসমূহ (বিদআত ও দুর্বল হাদিস)

⚠ ১. নির্দিষ্ট ১০০ রাকাত নামাজ পড়া – এর কোনো সহিহ প্রমাণ নেই।
⚠ ২. বিশেষ দোয়া প্রচলন করা (“নিসফু শাবান” বা শবে বরাতের নির্দিষ্ট দোয়া) – এটি হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়।
⚠ ৩. আতশবাজি, মিষ্টি বিতরণ ও আলোকসজ্জা করা – এটি ইসলামি সংস্কৃতির অংশ নয়।
⚠ ৪. একসঙ্গে মিলাদ-মাহফিল আয়োজন করা – রাসুলুল্লাহ ﷺ বা সাহাবারা কখনো এমন করেননি।

✅ শবে বরাত থেকে আমরা কী শিক্ষা নিতে পারি?

🔹 তওবা ও ইস্তিগফার: গুনাহ মাফ করানোর সুযোগ পাওয়া যায়।
🔹 কুরআন ও নামাজের গুরুত্ব: এই রাতে বেশি বেশি ইবাদত করা উচিত।
🔹 রিজিক ও ভাগ্য নির্ধারণ: পরবর্তী এক বছরের জন্য আল্লাহর কাছে বরকত প্রার্থনা করা দরকার।
🔹 উম্মতের কল্যাণ কামনা: নবী ﷺ উম্মতের জন্য দোয়া করেছেন, তাই আমরাও দোয়া করব।
🔹 রোজার গুরুত্ব: ১৫ শা’বান রোজা রাখা সুন্নতের একটি অংশ।

কুরআন ও হাদিসের আলোকে শবে বরাতে কি ভাগ্য নির্ধারিত হয়?

শবে বরাত সম্পর্কে অনেকের মধ্যে একটি সাধারণ ধারণা আছে যে এই রাতে মানুষের ভাগ্য নির্ধারিত হয়। তবে, এ বিষয়ে কুরআন ও সহিহ হাদিস কী বলে, তা বিশ্লেষণ করা গুরুত্বপূর্ণ।

✅ ১. শবে বরাত ও ভাগ্য নির্ধারণ – কুরআনের বক্তব্য

অনেকেই দাবি করেন যে, সুরা আদ-দুখান (৪৪:৩-৪) এর আয়াতগুলো শবে বরাতের সঙ্গে সম্পর্কিত:

إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُّبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ

অর্থ:
“নিশ্চয়ই আমি এক বরকতময় রাতে (আল-কুরআন) অবতীর্ণ করেছি। নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এই রাতে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়।”
(সুরা আদ-দুখান: ৩-৪)

📌 তবে অধিকাংশ তাফসিরকারক একমত যে, এখানে ‘বরকতময় রাত’ বলতে শবে বরাত নয়, বরং শবে কদরকে বোঝানো হয়েছে।

🔹 ইমাম ইবন কাসির (রহ.) বলেন:

“এই আয়াতে ‘লাইলাতুম মুবারাকা’ দ্বারা শবে কদর বোঝানো হয়েছে, শবে বরাত নয়। কারণ কুরআন স্পষ্টভাবে বলে যে, কুরআন রমজানের কোন এক রাতে অবতীর্ণ হয়েছে (সুরা আল-কদর: ১-৩, সুরা বাকারা: ১৮৫)।”

👉 অতএব, কুরআনের আলোকে শবে বরাতে ভাগ্য নির্ধারণ হয় বলে কোনো স্পষ্ট দলিল নেই। বরং শবে কদরেই তা হয়।

✅ ২. শবে বরাতে ভাগ্য নির্ধারণ – হাদিসের দৃষ্টিকোণ

কিছু হাদিসে এসেছে যে, শবে বরাতে আল্লাহ বান্দাদের রিজিক ও মৃত্যু নির্ধারণ করেন। তবে, এ সংক্রান্ত হাদিসগুলোর অধিকাংশই দুর্বল (দাঈফ) বা জাল (বানোয়াট) বলে হাদিস বিশারদগণ মত দিয়েছেন।

🔹 দুর্বল হাদিস:

“শা’বানের ১৫তম রাতে আল্লাহ বান্দাদের এক বছরের আমলনামা, রিজিক ও মৃত্যুর বিষয় স্থির করেন।”
(তাবারানি, বাইহাকি – হাদিসটি দুর্বল বলে অভিহিত হয়েছে)

📌 হাদিস বিশারদদের মন্তব্য:

  • ইমাম ইবনুল জাওজি (রহ.) বলেছেন, এই হাদিসগুলোর কোনো শক্তিশালী সূত্র নেই।
  • শাইখ আলবানী (রহ.) বলেছেন, শবে বরাতে ভাগ্য নির্ধারণ হয় এমন কোনো সহিহ হাদিস পাওয়া যায় না।

👉 তাহলে ভাগ্য নির্ধারণ কখন হয়?

📌 সহিহ হাদিস অনুযায়ী, মানুষের ভাগ্য নির্ধারিত হয় ৪টি সময়ে:
1️⃣ মায়ের গর্ভে থাকাকালীন (৪ মাস বয়সে) – তখন মানুষের জীবন, মৃত্যু, রিজিক ও তাকদির লেখা হয়। (সহিহ বুখারি: ৩২০৮, সহিহ মুসলিম: ২৬৪৩)
2️⃣ শবে কদরে – এক বছরের জন্য আল্লাহর ফায়সালা প্রকাশিত হয়। (সুরা কদর: ১-৩)
3️⃣ প্রত্যেক বছরের হিসাব কিয়ামতের দিন পেশ করা হবে।
4️⃣ চূড়ান্ত তাকদির লাওহে মাহফুজে সংরক্ষিত আছে। (সুরা হাদিদ: ২২)

👉 অতএব, ভাগ্য নির্ধারণের সঙ্গে শবে বরাতের সরাসরি সম্পর্ক নেই।

শবে বরাতে কাদেরকে মাফ করা হবে না?

শবে বরাত হলো গুনাহ মাফ, রহমত ও বরকতের রাত। তবে হাদিস অনুযায়ী, কিছু ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা এই রাতে ক্ষমা করেন না, যদি তারা অনুতপ্ত না হয় এবং প্রকৃত তওবা না করে।

✅ সহিহ হাদিস থেকে প্রমাণ

🔹 রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:

“শা’বানের পনেরোতম রাতে আল্লাহ তাআলা তাঁর সৃষ্টির দিকে দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক (যে আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করে) ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন।”
(সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস: ৫৬৬৫)

🔹 অপর এক হাদিসে এসেছে:

“এই রাতে আল্লাহ সমগ্র সৃষ্টি জগতে রহমতের দৃষ্টি দেন এবং শিরককারী, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী, অহংকারী ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করেন।”
(বায়হাকি, শু’আবুল ঈমান: ৩/৩৮২, তাবারানি, হাদিসটি হাসান)

❌ যেসব ব্যক্তিকে শবে বরাতে ক্ষমা করা হবে না

১. মুশরিক (যারা আল্লাহর সঙ্গে শরিক করে)

📌 শিরক সবচেয়ে বড় গুনাহ এবং এটি মাফযোগ্য নয়, যদি কেউ অনুতপ্ত হয়ে ইসলামের পথে ফিরে না আসে।

🔹 আল্লাহ বলেন:

إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ
অর্থ: “নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সঙ্গে শরিক করাকে ক্ষমা করবেন না, তবে এর চেয়ে কম গুনাহ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন।”
(সুরা আন-নিসা: ৪৮)

২. বিদ্বেষ ও হিংসা পোষণকারী

📌 যারা অন্যের প্রতি ঈর্ষা, বিদ্বেষ ও শত্রুতা পোষণ করে এবং ক্ষমা করতে অক্ষম, তাদের এই রাতে ক্ষমা করা হয় না।

🔹 রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন:

“প্রতি সপ্তাহের সোমবার ও বৃহস্পতিবার দিনে বান্দাদের আমল আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়। তখন আল্লাহ বলেন ‘যে ব্যক্তি অন্যের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে, তাকে ক্ষমা করা হবে না, যতক্ষণ না সে তার বিদ্বেষ পরিত্যাগ করে।'”
(সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৫৬৫)

৩. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী

📌 যারা আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে, তাদের ক্ষমা করা হয় না, যতক্ষণ না তারা সংশোধন করে।

🔹 রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন:

“আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হবে সেই ব্যক্তি, যে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে।”
(সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫৯৮৪)

📌 তাই, এই রাতে আত্মীয়দের সঙ্গে মিলেমিশে চলা ও ক্ষমা চাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

৪. অহংকারী ও আত্মগর্বকারী ব্যক্তি

📌 যারা অহংকার করে এবং নিজেকে বড় মনে করে, তাদের ক্ষমা করা হবে না।

🔹 রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন:

“যে ব্যক্তি তার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণ অহংকার পোষণ করে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।”
(সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯১)

📌 অতএব, অহংকার ও আত্মগর্ব থেকে মুক্ত হওয়া জরুরি।

৫. ব্যভিচারী ও নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি

📌 যারা ব্যভিচার করে বা নিয়মিত হারাম কাজে লিপ্ত থাকে এবং যারা নেশা গ্রহণ করে, তারা এই রাতে ক্ষমা পায় না।

🔹 রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন:

“নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি ও ব্যভিচারী ব্যক্তি তওবা না করা পর্যন্ত ক্ষমা পাবে না।”
(ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৪০২৯)

📌 অতএব, যারা এসব গুনাহর মধ্যে আছে, তাদের উচিত এই রাতে খাঁটি অন্তরে তওবা করা।

৬. সুদখোর ও অন্যের হক নষ্টকারী

📌 সুদখোর, ঘুষখোর ও যারা মানুষের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করে, তাদের ক্ষমা করা হয় না।

🔹 আল্লাহ বলেন:

“যারা সুদ ও ঘুষ খায়, তারা কিয়ামতের দিন শয়তানের আঘাতে উন্মাদ হয়ে উঠবে।”
(সুরা বাকারা: ২৭৫)

✅ শবে বরাতকে কোন ক্ষেত্রে বিদআত মনে করা হয়?

📌 বিদআত মানে কি?
🔹 বিদআত (إبدَاع) অর্থ হলো ধর্মে নতুন কিছু সংযোজন করা, যা রাসুলুল্লাহ ﷺ ও সাহাবাদের আমলে ছিল না।

🔹 রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:

“যে আমাদের এই ধর্মে এমন কিছু সংযোজন করল, যা এর অংশ নয়, তা প্রত্যাখ্যানযোগ্য।”
(সহিহ বুখারি, হাদিস: ২৬৯৭; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৭১৮)

📌 শবে বরাতকে বিদআত বলার কারণ:

1️⃣ নির্দিষ্টভাবে ১৫ শা’বান রাতে নামাজ ও ইবাদতের বিশেষ নিয়ম নির্ধারণ করা – এটি রাসুল ﷺ এবং সাহাবারা কখনো করেননি।
2️⃣ এই রাতে বিশেষ ৬ রাকাত বা ১০০ রাকাত নামাজ পড়ার বিধান – এটি কোনো সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়।
3️⃣ মসজিদে দলবদ্ধ হয়ে মিলাদ, ফাতিহা ও মোমবাতি জ্বালানো – এগুলো ইসলামের অংশ নয়।
4️⃣ বিশেষ খাবার রান্না ও মিষ্টি বিতরণ করা – সাহাবাদের যুগে এসব প্রথা ছিল না।
5️⃣ আতশবাজি ও আলোকসজ্জা করা – এটি একেবারেই অনৈসলামিক সংস্কৃতি।

ইসলামী বিশেষজ্ঞগণদের মতামত

📌 যারা শবে বরাতকে বিদআত বলেন:

🔹 ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ (রহ.) বলেন:

“শা’বানের ১৫তম রাতে কোনো বিশেষ ইবাদতের নিয়ম ইসলামে নেই। তবে যদি কেউ স্বাভাবিক নফল ইবাদত করে, তাহলে তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু একে শবে কদরের মতো মনে করা বিদআত।”

🔹 শাইখ আলবানী (রহ.) বলেন:

“শবে বরাতের রাতের ফজিলত প্রমাণিত হলেও, এই রাতে নির্দিষ্ট নামাজ ও ইবাদতের নিয়ম নির্ধারণ করা বিদআত।”

✅ যারা শবে বরাতকে কোন ক্ষেত্রে বিদআত মনে করা হয় না।

🔹 ইমাম শাফেয়ী (রহ.) বলেন:

“পাঁচটি রাত এমন রয়েছে, যেগুলোতে দোয়া কবুল হয়। তার মধ্যে শবে বরাত অন্যতম।”

🔹 ইমাম ইবনু রজব (রহ.) বলেন:

“শবে বরাতের ফজিলত প্রমাণিত, তবে বিশেষ কোনো আমল করার দলিল নেই।”

আরোও পড়ুন:-

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *